লেখার শুরুতেই বলে রাখি, ওরা এই সংবর্ধনা পুরস্কারটি ঠিক কেন দিয়েছে, কি প্রক্রিয়ায় তাদের বাছাই পর্ব সম্পন্ন করেছে তা ওদের নিয়ম অনুযায়ী ওরা পুরস্কার গ্রহীতাদের কাছে উন্মুক্ত করেন নি। তাই আমার এই ক্ষুদ্র আইন পেশার ক্যারিয়ারে যে আইডিয়াটির জন্য এই এ্যাওয়ার্ডটি আমি পেতে পারি সেটি সকলের অবগতীর জন্যই শেয়ার করছি।
 |
| বিচারপতি ড. আবু তারিক স্যার এবং মার্গুব মোর্শেদ স্যারের হাত থেকে এ্যাওয়ার্ড গ্রহনের মূহুর্ত |
আইডিয়াটি হল, আমরা সকলেই জানি আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে মিথ্যা মামলা হয় একইসাথে সত্য অনেক ঘটনার সঠিক বিচার ও হয়না। আবার প্রায় প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রেই বছরের পর বছর সময় চলে যায় অদৃশ্য বিভিন্ন কারনে। এসব মিলিয়ে মূলত বিচারপ্রার্থী ই বেশী হয়রানির শিকার হন। শেষ জমিটা বেচেও যখন পুত্র হত্যার বিচার পান না তখন সমাজের প্রতি একবুক কষ্ট এবং ঘৃর্ণা নিয়েই বেচে থাকতে হয় অনেকের।
তা যাইহোক,
এই ঘটনাগুলো আসলে কেন হয়?
এ থেকে উত্তরেন কি কোন উপায় নেই?
ঠিক কি পদ্ধতি অনুসরন করলে এ থেকে উত্তরণ হওয়া যাবে?
এরকম কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরেই রয়েছে এই সমস্যাগুলোর সমাধান।
এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই দৃষ্টি দিতে হবে আমাদের বিচার ব্যাবস্থায়। আমরা আজ এখানে শুধু ফৌজদারি মামলার প্রি-ট্রায়াল স্টেজ নিয়ে আলোচনা করব, কারন মূলত এই স্টেজে সমস্যা হওয়ার দরুন ই পুরো সিস্টেম ফলো করেও সঠিক বিচার এই দেশের মাটিতে হয়না। ধনী এবং ক্ষমতাবানরা থেকে যান ধরাছোয়ার বাইরে।
পুরো বিষয়টি সহজভাবে বুঝাতে একটি উদাহরনের মাধ্যমে আলোচনাটা করা যাক, ধরি, জনাব এক্স এর ছেলে মি.ওয়াইকে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাত ৩.০৫ মি এর সময় খুন করা হল। এই ঘটনায় পুলিশ ঘটনাস্থলে আসল ৩.৩০ মি এর সময়। রাস্তা ফাকা থাকায় ও সময় পুলিশের বিষয়টি জানতে একটু দেরি হল।
যাইহোক, আইন অনুযায়ী (সিআরপিসি ১৭৪) প্রথমেই পুলিশের কাজ হল ওখানকার সুরতহাল রিপোর্টে তৈরি করা। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর ওখানকার আসেপাশের সাক্ষ্য প্রমান সংগ্রহ করা এবং যদি কোন আসামীকে ধরা সম্ভব হয় তবে তাকে আদালতে প্রেরণ করা।
এই ঘটনার পরে পুলিশের মূল কাজ হল এই ঘটনার একটি তদন্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেওয়া। যেই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিকে আদালত কার বিরুদ্ধে কি চার্জ গঠন করবে, কাকে কাকে সাক্ষ্যি হিসাবে জিঞ্জাসাবাদ করা হবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করবেন।
কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, পুলিশের প্রথম তদন্ত রিপোর্ট দিতে নির্ধারিত ১২০ দিনের যায়গায় ৩২০ দিনেও সম্ভব হয়ে ওঠে না এই রিপোর্ট পেশ করা। আবার অনেকক্ষেত্রেই পুলিশ এই রিপোর্ট দিলেও বাদি বা ভিকটিম এর নারাজি পিটিশনের মূখে আবার ও এই তদন্তের ভার চলে যায় অন্য কোন বাহিনী যেমন সিআইডি,পিবিআই ইত্যাদির হাতে। সেখানে আরও বেশ কয়েকবছর পর চার্জ গঠন করে মূল মামলার কার্যক্রম অর্থ্যাৎ সাক্ষ্য গ্রহন থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পন্ন করে তারপর রায়ের সময় আসে।।
আসলে এই পুরো বিষয়টি সম্পন্ন হতে এত লম্বা সময় ব্যায় হওয়ায় যেমন মমলাটার বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমান ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি ভিকটিমও এই লম্বা সময় ধরে তদবির করার পেছনে খরচ করতে করতে পথে বসে যায়, যেকারনে ভিকটিমের আর বিচার পাওয়া হয়ে ওঠে না।
এরকম বিচারহীনতার দৃষ্টান্ত থাকার কারনেই অপরাধীরা মূলত বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিনদিন।
যেভাবে এই বিষয়টির সমাধান করা যেতে পারেঃ
আসলে কোন একটি অপরাধ হওয়ার পর প্রথম সেখানে যায় পুলিশ। পুলিশ ই অপরাধ হওয়ার পরে প্রথম ওই বিষয়টি নিয়ে কাজ করে একইসাথে এর তদন্তের ভারও পরে পুলিশের উপর। কিন্তু একটি মামলায় যে অগনীতবার নারাজী পিটিশনের পর এই বাহিনী থেকে ওই বাহিনীকে তদন্তের ভার হস্তান্তর করার একটি ব্যাড প্রাক্টিস বা খারাপ নজীর আমাদের দেশে আছে এর মূল কারনটি হল ওই তদন্তকারী কর্মকর্তার জবাবদিহীতার যায়গাটি অনেক নড়বড়ে।
আসলে সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে এক্সিকিউটিভ তথা পুলিশ বাহিনী এবং জুডিশিয়ারী বডি কে একত্রে কাজ করতে হবে। তবেই সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিজন তদন্তকারী কর্মকর্তার আসলে এক্সিকিউটিভ জবাবদীহিতার সাথে সাথে জুডিশিয়াল বডির নিকটও একটি জবাবদিহীতার যায়গা তৈরি করা উচিত।
বিষয়টি এমন হতে পারে, ধরুন একটি তদন্ত সম্পন্ন করার পর যদি ওই বিষয়ে বাদী নারাজী পিটিশন দেয় অথবা মামলা চুড়ান্তভাবে প্রমাণিত না হয় তবে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে জমা দিতে হবে যেখানে কোন আসামী বাদ গেল কিনা চার্জশিট বাদ গেলে বাদ যাওয়ার কারন কিংবা এমন কোন ব্যাক্তিকে অপ্রোয়জনীভাবে জড়িত করা হয়েছে কিনা কিংবা করা হলে তাকে কেন যুক্ত করা হয়েছিল অথবা সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ কেন সংগ্রহ করা গেলে না এসব বিষয়ে, যা মূলত একটি চেক্স এন্ড ব্যালেন্স তৈরি করবে এবং এর মাধ্যমে অনেক অসাধু পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে যে ঘুষের মাধ্যমে চার্জশিট প্রদান থেকে শুরু করে এভিডেন্স লোপাটের অভিযোগ রয়েছে সেটি করার আর সুযোগ থাকবে না।
আবার ধরুন বিষয়টি এমনও হতে পারে, একটি মামলার শেষে বিচার বিভাগ থেকে নিদৃষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিষয়ে একটি ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট নির্বাহী বিভাগকে পাঠানো যেতে পারে যাতে নির্বাহী বিভাগ তার কর্মক্ষমতা যাচাই করার একটি সুযোগ পায়। এই রিপোর্টটির উপর ওই নিদৃষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বেতন প্রমোশনের বিষটি সম্পৃক্ত করে দিলে পুরো সিস্টেমটি অটোমেটিকলি চেকড এন্ড ব্যালেন্স হয়ে যাবে।
আসলে এই দেশ আমাদের সকলের, একে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুন্দর এবং বাসযোগ্য করার দায়িত্ব আমাদেরই। আইনের শাসন থেকে শুরু করে সকল কিছু যদি চেকড এন্ড ব্যালেন্সে না থাকে তবে কিন্তু সত্যিকারের শান্তি আশা করা যায় না।
এই আহ্বানটি আমি একজন এ্যাডভোকেট বিধায় বিষয়টিকে জুডিশিয়াল বডির হিসাবে চিন্তা না করে বরং দেশের স্বার্থে কিভাবে এই ধারনাটি আরও স্পেসিফিকভাবে উন্নতি করে বাস্তবায়ন করা যায় সে বিষয়ে একত্রে কাজ করি।
দিন শেষে, দেশ ভাল থাকলে ভাল থাকব আমরা- আমাদের সন্তানরা।